রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও ইসরায়েল: এক জটিল সম্পর্কের ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ২২:১৯

প্রয়াত ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
প্রয়াত ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবন, রাজনীতি ও বিশ্বদর্শনের অনেক দিক নিয়ে আলোচনা হয় নিয়মিত। তাঁর সাত দশকের শাসনামলে তিনি বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশ সফর করেছেন, লক্ষাধিক মাইল ভ্রমণ করেছেন, নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। অথচ, একটি রাষ্ট্র আছে যেখানে তিনি কোনোদিনও পা রাখেননি—ইসরায়েল। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি ইসরায়েলের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বাকিংহাম প্যালেসের দরজাও প্রায়শই বন্ধ রেখেছিলেন। এই মনোভাবের পেছনে কী ছিল, সেটি জানতে হলে ফিরতে হবে ইতিহাসের গভীরে।
বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলিদের প্রবেশে আপত্তি
ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন এক অনুষ্ঠানে রানির মনোভাব নিয়ে খোলাখুলি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রানি এলিজাবেথ মনে করতেন, প্রায় প্রত্যেক ইসরায়েলি হয় "সন্ত্রাসী" নয়তো "সন্ত্রাসীর সন্তান।" তাঁর দাবি অনুযায়ী, রানি কোনো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক আয়োজন ছাড়া বাকিংহাম প্যালেসে কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে ঢুকতে দিতেন না। এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তা সীমিত ছিল।
রানি এলিজাবেথ নিজে কখনো এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি, তবে তাঁর নীতিগত অবস্থান ও দাপ্তরিক কর্মপন্থা থেকে ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ জটিল ছিল।
ইতিহাসের রক্তাক্ত ছায়া: ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও ইহুদি সশস্ত্র বিদ্রোহ
রানির এই মনোভাবের মূল ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট চালু ছিল। তখন ইহুদি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে নামে। “ইরগুন”, “হাগানা” এবং “লেহি” নামের এসব গোষ্ঠী একাধিকবার ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমে কিং ডেভিড হোটেলে বোমা হামলায় ৯১ জন নিহত হন, যেটি ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্র। এসব ঘটনাকে ব্রিটিশরা ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে দেখেছিল এবং সেই সময়কার অনেক রাজপরিবারের সদস্য—বিশেষত এলিজাবেথের পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জ—ব্যাপারটি গভীরভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
সম্ভবত সেই ঐতিহাসিক ক্ষত রানির মনেও রয়ে গিয়েছিল। যদিও তিনি সরাসরি এসব বিষয়ে মন্তব্য করেননি, তবে তাঁর রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে তার ছায়া পড়েছে বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
কখনো ইসরায়েল সফরে যাননি রানি এলিজাবেথ
রানির দীর্ঘ রাজত্বকালে যেসব দেশ তিনি সফর করেছেন, সেগুলোর তালিকা বিস্ময় জাগানিয়া। কমিউনিস্ট চীন, সৌদি আরব, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক দেশেও তিনি সফর করেছেন, কিন্তু ইসরায়েল কখনোই তাঁর তালিকায় ছিল না। ২০১২ সালে Haaretz পত্রিকার সাবেক প্রধান সম্পাদক ডেভিড লানদাও এ বিষয়ে লিখেছিলেন, “রানির ইচ্ছা থাকলে তিনি সফরে যেতেই পারতেন। রাজপরিবারের ক্ষমতা ও অবস্থান এমন যে, কেউ চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না।”
তবে অন্যদিকে, ব্রিটেনের প্রভাবশালী কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েল গ্রুপের এক নেতা স্টুয়ার্ট পলক দাবি করেন, রানিসহ রাজপরিবারের সদস্যদের ইসরায়েল সফরের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ এটি রাজনীতিনির্ভর সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যক্তিগত অনীচ্ছে নয়।
‘ভীতিকর’ অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া
রানির ইসরায়েলবিরোধী মনোভাবের আরেকটি চিত্র ফুটে ওঠে ১৯৮৪ সালের জর্ডান সফরে। সে সময় তিনি ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের আকাশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উড়তে দেখে আতঙ্কিত হন এবং সেই অভিজ্ঞতাকে ‘ভীতিকর’ বলে উল্লেখ করেন। যদিও রাজপরিবারের সদস্যরা সচরাচর এই ধরনের প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন না, তবু এ মন্তব্যটি তাঁর মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়।
রাজনীতি, ইতিহাস, ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের মিশেল
রানির ইসরায়েলের প্রতি মনোভাব কি একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ছিল? নাকি এটি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন? একদিকে তিনি ছিলেন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাংবিধানিক রূপ, যাঁর হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন রাজপরিবারের প্রধান, যার প্রতীকী অবস্থান বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রানি এলিজাবেথের ইসরায়েলের প্রতি শীতল মনোভাব একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মৃতি, কূটনৈতিক সমীকরণ এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধ সব মিলিয়ে একটি সূক্ষ্ম অবস্থান তৈরি করেছিল, যা তাঁর আচরণে প্রকাশ পেয়েছে।
রানির নীরব বার্তা
ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য, রানির সফরের অনুপস্থিতি, বাকিংহাম প্যালেসে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা—সব মিলিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার: ব্রিটেন ও ইসরায়েলের সম্পর্ক যতই কূটনৈতিক হোক, রানির মনোভাব তাতে চিরকালই ছিল সংরক্ষিত ও সীমিত।
এই ইতিহাস শুধু একজন রানির পছন্দ-অপছন্দ নয়—এটি রাজনীতি, উপনিবেশবাদ, বিদ্রোহ এবং সমসাময়িক ভূরাজনীতির এক জটিল মেলবন্ধন। রানি এলিজাবেথ হয়তো কখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেননি, কিন্তু তাঁর নিরবতাই বলে দিয়েছিল অনেক কিছু।