যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল
কারণ জানে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০৯

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ব্যাপক হারে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির একাডেমিক মহলে। চলতি বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত এবং সদ্য স্নাতক হওয়া অন্তত ১ হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে মার্কিন সরকার। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এমন কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই জানতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৪০টি অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চিত করেছে যে, তাদের বেশ কিছু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা ও দেশটিতে থাকার বৈধতা বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া ভিসাগুলোর বেশিরভাগই F-1 ও J-1 ক্যাটাগরির, যা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য নির্ধারিত।
এসব শিক্ষার্থীর নাম যুক্তরাষ্ট্রের স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেম (SEVIS)-এ তালিকাভুক্ত ছিল। তবে তথ্যভাণ্ডারে হঠাৎ পরিবর্তনের মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা তথ্য আদান-প্রদান করা হয়নি।
মিডল টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র জিমি হার্ট জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের পরিবর্তনের নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানে না। আমাদের কেবল জানানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে শিক্ষার্থীদের স্ট্যাটাসে পরিবর্তন এসেছে।”
ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র এরিক হাওয়াল্ড বলেন, “আমাদের চারজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ আমাদের কিছুই জানায়নি—না কোনো অভিযোগের ধরন, না কোনো আগাম নোটিশ।”
এছাড়াও, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেস (UCLA) জানিয়েছে, তাদের অন্তত ১২ জন শিক্ষার্থী ও সদ্য স্নাতকের ভিসা বাতিল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হুলিও ফ্রেঙ্ক এক বিবৃতিতে বলেন, “বাতিলের নোটিশে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভিসার শর্ত লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু এর কোনটা, তা পরিষ্কার নয়।”
যদিও মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি, তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে—অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তারা রাজনৈতিক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, অথবা অতীতে করা ছোটখাটো অভ্যন্তরীণ আইন লঙ্ঘনের জন্য তারা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এ প্রসঙ্গে বলেন, “তাঁরা এখানে ক্লাস করতে এসেছেন। আন্দোলন করতে নয়। যেসব কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করে, সেসব আমরা সহ্য করব না।”
এই বক্তব্যের ফলে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার হুমকির মুখে পড়ছে।
ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ইতোমধ্যে আটলান্টার নর্দার্ন জর্জিয়া ফেডারেল আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ভারত, চীন, মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও জাপান থেকে আসা ১৩৩ জন শিক্ষার্থীর ঘটনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মামলায় তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা—অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী ক্রিস্টি নোয়েম এবং আইসিইর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লায়ন্সকে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, অভিবাসন ও শুল্ক বাস্তবায়ন সংস্থা (ICE) বেআইনিভাবে শিক্ষার্থীদের বৈধতা বাতিল করেছে এবং এতে তাদের শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত তাদের অবৈধ বসবাসকারী হিসেবে বিপদে ফেলেছে, এমনকি গ্রেপ্তার ও বিতাড়নের ঝুঁকিতেও ফেলেছে।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা সহনশীলতা’র নীতির পরিপন্থী। অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দেশটিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আসেন এবং তাদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু বৈচিত্র্যই অর্জন করে না, বরং তাদের টিউশন ফি এবং গবেষণায়ও বড় অবদান পড়ে।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারস (NAFSA) বলছে, “এই ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে দেশটি প্রতিভাবান ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের হারাবে।”
এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। তারা জানেন না, তাদের এখনই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হবে কিনা, নাকি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এখানেই থাকতে পারবেন। অনেকেই মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো এখন মার্কিন প্রশাসনের কাছে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায়—তাদের শিক্ষা, স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত আবারও বিবেচনা করা হবে কি না।