
এই তেপান্তরের মাঠের মতো ধানক্ষেতগুলো আসলে একটা বিল। বিলের নামটি পোড়াদহ। প্রাকৃতিক জলাশয়ের বয়স লোকালয়ের চাইতে বেশিই হয়। লোকে আগে জলের পাড়ে বসতি গড়ত, বসতি গড়ে জলাশয় বানাত না। এই বিলের বয়সও দুইপাশের লোকালয়ের বয়সের চাইতে বেশি।
লোকালয়ে ঘর তোলা মানুষ, মাঠে চরে বেড়ানো গরু-ছাগল এসবের পুরো ইতিহাসটা জানে এই বিল। বিল নিয়ে দুই পাড়ের লোকেদের কথা-স্মৃতি-শ্রুতির পরিমাণ বিলের পুরো বয়সে এর বুকে যত পানি বয়ে গেছে, তার চাইতে বেশিই হবে।
ওলা ওঠায় বাপ-মা মরা অছিম সেক নানার সংসারে বড় হয়েছিলেন। সকালে সবাই যখন গায়ের মক্তবে যেত, উনি যেতেন হাল-চাষ করতে। নানা অছিম সেককে ভাত দেয় আর পালের গরুরে দেয় ঘাস; উদ্দেশ্য একই। অছিম সেক মক্তবে যাননি বলে, দোয়া-কালাম জানতেন না মোটেই এমনকি নামাজও পড়তে পারতেন না। উনি বলতেন, ‘খোদা দেখেছেন আমি কেমন ছিলাম, কেন নামাজ পড়ি নাই, উনি মাফ করে দিবেন।’ খোদা মাফ করেছেন কি না সে খবর জানা নেই, কিন্তু এই বিল সাক্ষী দেবে অছিম সেক মিথ্যে বলেননি।
অছিম সেকের কিশোরী বৌ ছলিমন, কতই না ভালোবাসত তাকে। যে লোককে বিয়ের আগে একদিনও দেখেনি ছলিমন, বিয়ের পর তার প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না। বিহানে স্বামী হাল নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো কোনো কারণে গোমড়ামুখ নিয়ে গেছে, ছলিমনের সারা দিন প্রাণ উচাটন থাকত তাতে। বিলের ঘাটে বসে মাঠের দিকে তাকিয়ে দূরে ছায়ার মতো দেখতে পাওয়া মানুষদের মাঝে, ছলিমন চিনে নিতে চাইত তার স্বামীকে। বিলের দিকে তাকাত ছলিমন, বিল তাকাত ছলিমনের দিকে আর নীরবে বলে যেত, ‘সোয়ামির সোহাগ নিয়েই তুই মরবি।’ হয়েছিল তাই, স্বামীর মৃত্যুর বহু আগে চলে গিয়েছিল ছলিমন।
রাতের বেলায় একবার একজনকে ধরা হলো চুরির অভিযোগে। কেউ বলতে পারল না, লোকটা কী চুরি করেছে। কেউ কেউ বলল, ওই পাড়ের ঘাটে এ ছেলেটা মাঝেমধ্যেই বিকেলে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় কিছু চুরি করবে বলেই খোঁজখবর নিতে আসে হয়তো। ছেলেটা একটাও কথা বলেনি। জল টলটলে চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল শুধু। পরদিন বিকেলে দোহারা একটা মায়াবী মেয়ে বিলের ঘাটে বসে বিলের অন্যপাশে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেছিল কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরও হয়তো বিলের অজানা ছিল না।
বিলের পাড়ে যে ঘন জঙ্গল, সেখানে কইতরী নামের এক বোবা নারীর লাশ পাওয়া গেল। লোকে এখনো বলে, কইতরী ইয়া বড় এক হাতি দেখে ভয়েই মরেছে। আর কেউ না জানলেও জঙ্গলের মিতা বিল জানে কইতরী দেখেছিল ভীষণ নোংরামি। হাতি দেখে কইতরী মরেনি, সে মরেছিল কোনো এক আপনজনের ভীষণ অপরিচিত রূপ দেখে।
বিল আর এখন বেঁচে নেই। বিল মরে হয়েছে ধানক্ষেত। কতজনের কত দুঃখ-ব্যথা বুকে নিয়ে মরে গেছে পোড়াদহ বিল। তার বুক খুঁড়লে জনপদের সব অতীতই হয়তো জানা যাবে।