
আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের কথা। তখন মোড়ে মোড়ে বিস্কুটের দোকান ছিল না। আমরা ভাত খেতাম আর নাশতায় খেতাম চিড়ে-মুড়ি। একটাই খাবার আমাদের বিলাসের বস্তু ছিল—পিঠা।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন মানুষ আসলেই গরিব ছিল। তবে কি এখন গরিব নেই? তা আছে বৈকি। তবে তখনকার গরিব আর এখনকার গরিবে রাত-দিন ফারাক। তখন ধানের মৌসুমের পর, মাস তিনেক সবাই তিনবেলা ভাত খেতে পারত আর বাকিটা সময় সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ দুবেলা আর কেউ একবেলা ভাত খেয়ে থাকত। চৈত্র মাসে ঘরে গম আসত, তাই দিয়ে লোকে রুটি খেত। অবস্থা অনুযায়ী কারও ঘরে একবেলা, কারও ঘরে দুবেলা রুটি হতো। আর যাদের ঘরে গম উঠত না, তারা না খেয়েও দিন গুজরান করত। এখনকার সময়ে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে কিন্তু তখন গমের আটার দাম চালের চেয়ে অনেকটাই কম ছিল।
তখন অভাব ছিল বলে কি উৎসব হতো না? হতো। উৎসব বলতে তখন ছিল দুটি ঈদ আর নবান্ন। এ তিনটি উৎসবে আমাদের প্রায় প্রতিটি ঘরেই পিঠা হতো। আর পিঠা হতো কারও মেয়ের জামাই বেড়াতে এলে বা মেয়ে নাইওর এলে।
মেয়ে বেড়াতে এলে বাপ-মা আহ্লাদ করে নয় বরং অনেকটাই অনুশোচনা থেকে পিঠা বানাত। শ্বশুরবাড়িতে ছিল মেয়ে, খাবার যা খেয়েছে বর, শাশুড়ি আর ননদের হাতের মার খেয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি। ও বাড়িতেও হয়তো পিঠা হয়েছে কিন্তু একদিন পিঠা খেয়ে পরদিন খোঁটা শোনার ভয়ে হয়তো মেয়ে পিঠা খায়নি।
আহাগো! মেয়েটা ফিরে এসেছে, নাও ফিরতে পারত। ও-পাড়ার মুর্শিদা যেমন ফেরেনি, পোয়াতি মেয়েটা। একদিন বাড়িতে খবর এল মুর্শিদা ফাঁস নিয়েছে। মুর্শিদার বাবা দেখলেন মুর্দা মেয়েটার সারা গায়ে চাকা চাকা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। অনেক কাঁদলেন, বিচার দিলেন পাড়ার মাদবরদের কাছে আর খোদার দরবারে। মাদবররা নালিশ কানেই তুলল না আর খোদা বিচার করবেন রোজ হাশরে।
মেয়ে ফিরলে, মা কাঁদে। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে নাকি আবার শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর আশঙ্কায়, সেই ধাঁধা থেকে যায়। তবে মা তৎপর হয়ে ওঠে মেয়ের জন্য পিঠা বানাতে। মেয়েকে পিঠা খাওয়ানোর জন্য মাচায় তুলে রাখা একটা কলসিতে চাল আর গুড় লুকিয়ে রেখেছিলেন আগেই। এর মাঝে কত আকাল গেল কিন্তু ওটাতে হাত পড়েনি ভুলেও। মেয়ে এলে সেই যক্ষের ধন চাল আর গুড় বের করে মা।
প্রতি বছর মেয়েকে নিতে জামাই আসে, এবারও আসবে। না এসে পারে! হাজার হলেও মেয়েটা এবার পোয়াতি হয়েছে। জামাইটা বেশ ভালো, এই মাসে চান্দে দুয়েকবার মেয়ের গায়ে হাত ওঠানো ছাড়া আর কোনো দোষ নেই তার। তবে বাচ্চা পেটে ধরার পর আর নাকি গায়েও হাত তোলে না। আহা! শাশুড়ির সোনার চান জামাই একটা।
মেয়ে এবার বেশ দেরি করে ফিরবে। পোয়াতি মেয়ে, একেবারে বাচ্চা কোলে নিয়ে ফিরবে শ্বশুরবাড়ি। জামাই নাকি ছেলে বাচ্চার দাবি জানিয়েছে, পাগল মানুষ একটা। ছেলে হবে না মেয়ে হবে তার ওপর কারও হাত আছে নাকি? মনে মনে ভাবেন, ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বাচ্চার মুখ দেখলেই জামাই ভুলে যাবেন। উনার নিজের দ্বিতীয় বাচ্চাটা মেয়ে হয়েছিল না? মেয়ের বাবা কি তাই মুখ ফিরিয়ে ছিল? শাশুড়ি আপনমনে হাসেন।
একদিন মেয়ের কোল আলো করে বাচ্চা আসে। ছেলে আসে না, আসে ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠানো হয়, মেয়ে বাচ্চার কথা শুনে ও বাড়ির সবাই গজগজ করতে থাকে। কেন জানি শাশুড়ির সব খোয়াবে পানি ঢেলে জামাই আর আসে না। তবে কি মেয়েকে আর শ্বশুরবাড়িতে ফেরত নেবে না?
মাসখানেক পর, সন্ধ্যার আগে আগে মুখ বেজার করে জামাই আসে। শাশুড়ি হাসে, সে জানে বাচ্চার মুখ দেখলে আর জামাইয়ের মুখ বেজার থাকবে না। জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে শাশুড়ি পিঠা ভাজে। পিঠা ভাজতে ভাজতে মনের সুখে গুনগুন করে গানও গায়। জামাই এসেছে, তার সোনার চান জামাই।
পিঠা ভাজা হলে, মেয়েকে ডাকেন জামাইয়ের জন্য পিঠা নিয়ে যেতে। মেয়ে এসে আহ্লাদে ঢলঢল করতে করতে বরের জন্য থালাভর্তি করে পিঠা সাজায়। আজ সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ, তার বর এসেছে বাচ্চা দেখতে। পিঠার ঘ্রাণে তার আর মন মানে না, একটা পিঠা মুখে দিয়ে ফেলে। মনে আজ সুখ বলে পিঠা যেন একটু বেশিই স্বাদ লাগে।
বরের হাতে পিঠা তুলে দিয়ে বাচ্চাকে কোলে নেয় মেয়ে। আহ্লাদে ডগমগ করতে করতে বাচ্চার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় সে। কিছুক্ষণ পর তার মনে হয় বাচ্চা ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমন্ত বাচ্চার মুখে চুমু খেতে গেলে নাকে তার বোঁটকা গন্ধ লাগে। হতভম্ব হয়ে যায় সে, কৃষকের মেয়ে বলে নিমিষেই বুঝে ফেলে এটা বিষের গন্ধ। মেয়ের আর্তনাদে লোক জমে যায়।
নিজের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত বাচ্চাটি বেঁচে যায়। জামাইকে কেউ কেউ পিটুনি দিতে চায় কিন্তু শাশুড়ি আটকান সবাইকে। উনি ঘরের কোনায় নিয়ে জামাইকে আবারও পিঠা খেতে দেন। মেয়ে তার বিলাপ করে কাঁদে আর জামাই মনোযোগ দিয়ে পিঠা খেতে থাকে। আহা! সোনার চান জামাই তার।