
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ করেই ঘন ঘন চোখে পড়ছে একটি শব্দ—‘কফিল’। কেউ তা নিয়ে রসিকতা করছে, কেউ আবার রাগ-ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া লাখো বাংলাদেশি শ্রমিকের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই ‘কফিল’ শব্দটি।
কফিল আসলে কে?
‘কফিল’ মূলত একজন নিয়োগকর্তা, যিনি প্রবাসী শ্রমিকের কাজের অনুমোদন, ভিসা, আবাসন অনুমতি (রেসিডেন্স পারমিট) থেকে শুরু করে অনেক প্রশাসনিক বিষয়ের দায়িত্বে থাকেন। তিনি শুধু মালিক নন—একজন শ্রমিকের জীবনযাত্রা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
একজন দায়িত্ববান কফিল হলে প্রবাসী শ্রমিকের দিন চলে শান্তিতে, আর দুর্ব্যবহারকারী কফিল হলে সেই জীবন রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে। কফিলের ছত্রছায়ায় থাকা দালালচক্রও শ্রমিকদের শোষণের অন্যতম উৎস—যারা প্রভাব খাটিয়ে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেয় এবং তাদের নানা রকম প্রতারণার ফাঁদে ফেলে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বাস্তবতা
আমাদের সমাজে বহু পরিবারই মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বজনের পাঠানো অর্থে জীবন চালায়। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, আরব আমিরাত—এসব দেশ হয়ে উঠেছে তাদের রুজির পথ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই রোজগারের পেছনে লুকিয়ে থাকে নিরব কান্না, কঠোর পরিশ্রম আর শোষণের কাহিনি।
৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, দিনে ১২–১৪ ঘণ্টা কাজ করেন অনেকেই। বিশ্রামের সুযোগ কম, দুর্ব্যবহার আর ঠকানোর ঘটনা বরাবরই বেশি। কেউ প্রতিবাদ করলে চাকরি হারানো বা জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি আসে। এমনকি কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়াও কফিলের অনুমতির ওপর নির্ভর করে।
কফিলভীতি: শ্রমিকের অদৃশ্য শিকল
কফিলদের ক্ষমতা এতটাই বিস্তৃত যে অনেক শ্রমিক তাদের সামনে মুখ খুলতেও ভয় পান। কাজের জায়গা বদলানো বা অন্য কোথাও চাকরি খোঁজা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ কফিল অনুমতি না দিলে সেটা করা যায় না। এভাবেই কফিল হয়ে ওঠে একটি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, যেটিকে অনেকে আধুনিক দাসপ্রথার সঙ্গে তুলনা করেন।
দক্ষতা বাড়ানোই মুক্তির উপায়
প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন জীবনের মানোন্নয়নের আশায়। কিন্তু দক্ষতার অভাবের কারণে তারা সহজেই প্রতারণা ও শোষণের শিকার হন। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে বিদেশ যাওয়ার আগে তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি।
ইলেকট্রিশিয়ান, গাড়িচালক, রন্ধনশিল্পী, প্লাম্বার—এই ধরনের কাজে দক্ষতা অর্জন করলে ভালো বেতনের চাকরির সম্ভাবনা বাড়ে। একই সঙ্গে মৌলিক আরবি ভাষাজ্ঞান থাকলে কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ সহজ হয় এবং প্রতারণার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে।
সরকারি পর্যায়ে আরও আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা—এসব পদক্ষেপ হলে শ্রমিকরা শুধু পরিশ্রম নয়, সম্মানও অর্জন করতে পারবেন।
ভাষা, প্রেক্ষাপট ও আমাদের উপলব্ধি
বাংলাদেশে ‘কফিল’ শব্দটি এখন অনেকটা উপহাস বা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে এটি একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে—নিয়োগকর্তার প্রতিশব্দ।