
অভিবাসনবান্ধব দেশ হিসেবে ইউরোপজুড়ে পরিচিত পর্তুগাল এখন সেই পরিচিতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। সাম্প্রতিক পার্লামেন্টারি অনুমোদনের মাধ্যমে দেশটি অভিবাসন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের পথে হাঁটছে—যেখানে কাজের ভিসা, পারিবারিক পুনর্মিলন এবং ব্রাজিলীয় নাগরিকদের স্বয়ংক্রিয় বসবাস অনুমতির মতো সুবিধাগুলোতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন এই পরিবর্তনের ফলে, ভবিষ্যতে পর্তুগালে অভিবাসনের সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে। বিশেষ করে যারা দক্ষিণ এশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকা থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশটিতে আসার চিন্তা করছেন, তাদের জন্য পথটা হয়ে উঠছে আরও সংকীর্ণ।
শুধু 'উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন' অভিবাসীদের জন্য কাজের ভিসা
পর্তুগিজ সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে কেবলমাত্র ‘উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন’ বিদেশি নাগরিকরাই দেশটিতে কাজের অনুমতি পাবেন। এর ফলে স্বল্পদক্ষ কিংবা অদক্ষ অভিবাসীদের জন্য পর্তুগালে বৈধভাবে বসবাস ও কাজের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সেই সঙ্গে, দীর্ঘদিনের পুরোনো যে নিয়মে ব্রাজিলীয় নাগরিকরা সহজেই পর্তুগালে বসবাসের অনুমতি পেতেন—সেটিও বাতিলের পথে। ভবিষ্যতে ব্রাজিলীয়দেরও অভিবাসন প্রক্রিয়ার নিয়মিত জটিলতা পেরিয়ে আসতে হবে।
নিয়ম ভেঙে আসা অভিবাসীদের জন্য নেই আর দ্বিতীয় সুযোগ
এতদিন পর্যন্ত পর্যটন ভিসায় এসে পর্তুগালে কাজ করে পরবর্তীতে বৈধতা অর্জনের সুযোগ ছিল। ২০১৮ সালের নীতিমালায় এই ‘নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়া’ বৈধ ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই সুবিধাটিও তুলে নিয়েছে। ২০২3 সাল থেকে বৈধ কাজের কাগজ ছাড়া কেউ পর্তুগালে প্রবেশ করতে পারছে না, যার ফলে অনিয়মিতভাবে কাজ শুরু করে পরবর্তীতে কাগজ বৈধ করার পথ এখন বন্ধ।
নতুন পুলিশ ইউনিট এবং নির্বাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ
সরকার অভিবাসনসংক্রান্ত আইন প্রয়োগে আরও কার্যকর হতে চায়। এ লক্ষ্যে নতুন একটি পুলিশ ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে তারা, যারা মূলত অনিয়মিত অভিবাসীদের শনাক্ত ও দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ করবে। ইতোমধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পার্লামেন্ট থেকে অনুমোদনও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশি অভিবাসীরা ক্ষুব্ধ, দূতাবাসের দাবি তোলা হয়েছে
এই ধারাবাহিক কঠোরতার প্রতিবাদে দেশটির রাজধানী লিসবনের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে গত বছর অক্টোবরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বহু অভিবাসী। সেখানে বাংলাদেশি অভিবাসীরাও অংশ নিয়েছিলেন এবং পর্তুগালের বাংলাদেশ দূতাবাসের অভাবের কারণে পারিবারিক পুনর্মিলনের জটিলতা তুলে ধরে ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ পর্তুগিজ দূতাবাস স্থাপনের দাবি জানান।
ডানপন্থার উত্থান ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টিনিগ্রোর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, “অভিবাসনে খোলা দরজার নীতিকে” বন্ধ করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এখন স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্তুগাল এখন স্পষ্টভাবেই ডানপন্থায় ঝুঁকছে—যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার এবং সামাজিক ভারসাম্যকে গুরুত্ব দিয়ে অভিবাসনকে কঠোর নজরদারির আওতায় নেওয়া হচ্ছে।
১৫ লাখের বেশি বিদেশির ভবিষ্যৎ শঙ্কায়
২০২৪ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, পর্তুগালে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১৫ লাখ ৫০ হাজার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের তুলনায় এই সংখ্যা চার গুণ বেশি। তবে নতুন নিয়মের কারণে যাদের বৈধতা নেই—যেমন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের প্রায় ১৮ হাজার অনথিভুক্ত অভিবাসী—তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।