প্রবাসী মাহবুব মাতব্বর
চারপাশে শুধু বালুর ঢিবি। নেই সবুজের ছোঁয়া, নেই মানুষের সান্নিধ্য। দিনের তপ্ত রোদে শরীর ঝলসে যায়, আর রাত নামলেই বুক ভরে ওঠে নিঃসঙ্গতায়। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জুড়ে শুধু শূন্যতা। মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, শোনা যায় কেবল বাতাসের হাহাকার আর বন্যপ্রাণীর ডাক।
এমন নির্মম পরিবেশেই দুই দশক ধরে জীবন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রবাসী মাহবুব মাতব্বর। পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর তাগিদে মরুভূমির কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
দালালের প্রলোভনে মরুভূমির খামারে
লিখতে-পড়তে না জানলেও এক বুক স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবের পথে রওনা দেন মাহবুব। দালালের মুখরোচক আশ্বাসে ভরসা করে তিনি যান রায় গানাম ভিসায়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কল্পনার চেয়েও কঠিন। শহর থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের এক নির্জন মরুভূমিতে একটি ছাগলের খামারেই তার ঠাঁই হয়।
দিনে প্রচণ্ড রোদে কাজ, রাতে হাড়কাঁপানো নিস্তব্ধতা। খাবার ও পানি আসত কয়েকশ কিলোমিটার দূরের শহর থেকে, যা তার জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলত।
মরুভূমিতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম
“এখানে আশ্রয় বলতে শুধু এক খুপড়ি ঘর। নেই বিদ্যুৎ, নেই শীতলতার কোনো ব্যবস্থা। সৌর বিদ্যুতের আলোয় রাত কাটাই। প্রতিদিন ভোরে উঠে ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মাঝেই ছাগলের খামারে কাজ করতে হয়। খাওয়ানো থেকে শুরু করে অসুস্থ হলে সেবা—সবই একা হাতে সামলাতে হয়।” — মাহবুব মাতব্বর, সৌদি প্রবাসী
তীব্র গরমে টিকে থাকতে পানির বোতল মুড়ে রাখতে হয় ভেজা পাটের বস্তায়। যেন দাউদাউ রোদে শরীর ঝলসে গেলেও অন্তত ঠান্ডা পানি গলায় নামিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।
কষ্টের সঙ্গে ঝুঁকিও স্থায়ী সঙ্গী
“এখানে শুধু কষ্ট নয়, বিপদও সবসময় ঘিরে রাখে। হঠাৎ আসা বালিঝড়ে দম বন্ধ হয়ে যায়, আবার যে কোনো সময় বিষাক্ত সাপ বা বিচ্ছুর আক্রমণের ভয় থাকে। অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। শহর থেকে চিকিৎসা বা সাহায্য পৌঁছাতে এক থেকে দুই দিন লেগে যায়।” — মাহবুব মাতব্বর, সৌদি প্রবাসী
খাবার সময়মতো না এলে অনাহারে প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে মরুভূমির খামারগুলিতে।
দালালের প্রতারণায় ভোগান্তি
মরুভূমির বুকে জীবন বাজি রেখে শুধু মাহবুব নন, আরও বহু প্রবাসী বাংলাদেশি প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছেন জীবনের সঙ্গে। দালালের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার প্রবাসীকে গুনতে হচ্ছে কষ্টার্জিত অর্থের মাশুল।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশগামী শ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত না করা গেলে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে না। সরকারি পর্যায়ে আরও কঠোর নজরদারি ও কার্যকর আইন প্রয়োগ জরুরি। তা না হলে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র পাল্টানো সম্ভব নয়।

