
২০২৪ সালে ইউরোপমুখী বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে ৫২ শতাংশ কমেছে। আগের বছর যেখানে ৪৬ হাজার ৪৫৫ জন কর্মী ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ২২ হাজার ২৭১ জনে। এই পতনের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি জটিল কারণ—অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি এবং কঠোর ভিসা নীতিমালা এর মধ্যে অন্যতম।
ইউরোপীয় নিয়োগদাতাদের মধ্যে অনাস্থা
সম্প্রতি বলকান ও নন-শেনজেন দেশগুলোতে কর্মী নিয়োগের পর দেখা গেছে, অনেক বাংলাদেশি কর্মী সেখানে গিয়ে মূল কাজ না করে অবৈধভাবে শেনজেনভুক্ত দেশগুলোর দিকে চলে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতির কারণে ইউরোপের অনেক নিয়োগদাতা এখন বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বিশেষ করে রোমানিয়া, পোল্যান্ড, মাল্টা, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে অনিচ্ছুক হয়ে উঠেছে।
ক্রোয়েশিয়ার উদ্বেগ এবং ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহারে অনিয়ম
২০২৪ সালে ক্রোয়েশিয়া ১২ হাজার ৪০০ বাংলাদেশিকে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করলেও, এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার কর্মী কখনোই দেশটিতে পৌঁছেননি। যারা গেছেন, তাদের অর্ধেকেরও কম কর্মী এখনো চাকরিতে আছেন।
ফলস্বরূপ, ক্রোয়েশিয়া বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট স্থগিত করার কথা ভাবছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
দক্ষতার অভাব বড় চ্যালেঞ্জ
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, গত পাঁচ বছরে ৪২ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কর্মসংস্থান পেয়েছেন, কিন্তু ইউরোপের অংশ ছিল মাত্র ২.৩৩ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষ কর্মী না থাকার কারণে এই বাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। ইউরোপে এখন মূলত বিশেষায়িত দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা বেশি, যেমন—টেকনিক্যাল কাজ, স্বাস্থ্যসেবা, হসপিটালিটি ইত্যাদি। অপরদিকে, কম দক্ষ পেশার চাহিদা কমে এসেছে।
ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা
ঢাকায় অনেক ইউরোপীয় দেশের দূতাবাস বা ভিসা সেন্টার না থাকায় ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
যেমন, বলকান দেশগুলোর জন্য প্রার্থীদের ভারত গিয়ে ভিসার আবেদন করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ভারতের পক্ষ থেকেও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিকল্প বাজার চিহ্নিত করার পরামর্শ
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত সার্বিয়া ও বসনিয়ার মতো দেশে শ্রমবাজার চিহ্নিত করে সেখানে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে অনিয়মিত অভিবাসন কমিয়ে বৈধ উপায়ে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে।
এছাড়া প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে সরকার-নির্ভর দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির বিস্তার প্রয়োজন।
কম কর্মী, বেশি রেমিট্যান্স
সংখ্যায় কম হলেও, ইউরোপে থাকা বাংলাদেশি কর্মীরা তুলনামূলকভাবে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপের ৯টি দেশ শীর্ষ রেমিট্যান্স উৎসের তালিকায় রয়েছে।
বিশেষ করে যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ১৭৭ কোটি ডলার এবং ইতালি থেকে ১০২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স।
এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে—যদি পরিকল্পিতভাবে অভিবাসন বাড়ানো যায়, তবে ইউরোপ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও শক্তিশালী হতে পারে।