জার্মান অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৪২

বিশ্বজুড়ে গুণগত উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি দীর্ঘদিন ধরেই অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। দেশটির বহু বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছে, যা অনেকের কাছেই এক অভাবনীয় সুযোগ। তবে, সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, শুধু সুযোগ নয়—এই বিনামূল্যের শিক্ষাব্যবস্থা জার্মানের জন্যও একটি লাভজনক বিনিয়োগ।
কোলনের জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউট (IW)-এর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২ সালে জার্মানিতে অধ্যয়ন শুরু করা প্রায় ৭৯ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী তাদের জীবনের পুরো সময় জুড়ে জার্মান কোষাগারে আয়কর ও সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ প্রায় ১ হাজার ৫৫০ কোটি ইউরো অর্থাৎ প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রাখবে। শুধু তা-ই নয়, এই শিক্ষার্থীরা দেশটির অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার ও শিল্পখাতেও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক প্রভাব
জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস (DAAD)-এর প্রেসিডেন্ট জয়ব্রত মুখার্জির ভাষায়, “আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের জন্য শুধু শিক্ষাগত সম্পদই নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্পদও বটে।” এ বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের অবদান এখন শুধুমাত্র শিক্ষা সীমায় আবদ্ধ নয়।
জার্মানির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সরকারি অনুদানে পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কোনো ফি না দিলেও তারা দেশে থেকে আয় করায় এবং ভ্যাট, সামাজিক নিরাপত্তা কর প্রদান করায় অর্থনীতিতে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন। অনেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করছেন, যার ফলে তারা শুরু থেকেই অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
থাকার হার এবং দীর্ঘমেয়াদি অবদান
২০২২ সালের OECD-এর একটি রিপোর্ট বলছে, যারা শিক্ষার্থী ভিসায় জার্মানিতে আসে, তাদের একটি বড় অংশ পড়াশোনার পরে দেশে থেকে যায়। যেমন ২০১০ সালে আগতদের প্রায় ৪৫ শতাংশ দশ বছর পরেও জার্মানিতে ছিলেন। গবেষকরা অনুমান করছেন, যদি অন্তত ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাত্র তিন বছর জার্মানিতে অবস্থান করেন, তবে সরকার তাদের পড়াশোনার পিছনে যে খরচ করে, সেটি আয়করের মাধ্যমেই উঠে আসে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তবে এই চিত্রের উল্টোপিঠও রয়েছে। ডিগ্রি শেষ করার পর বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরি পাওয়া কিছুটা কঠিন হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব খণ্ডকালীন চাকরি সহজলভ্য, সেগুলো গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পাওয়া যায় না। পাশাপাশি, জার্মানির বড় শিল্প খাত, বিশেষত গাড়ি শিল্প, বর্তমানে মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আউডি ও ভল্কসওয়াগেনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রতি কর্মী ছাঁটাই করেছে, যা বিদেশি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরির সুযোগ কমিয়ে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে IW গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। তারা বলছে, অভিবাসন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও নমনীয় করতে হবে, যাতে বিদেশি গ্র্যাজুয়েটরা সহজে শ্রমবাজারে ঢুকতে পারেন। পাশাপাশি, চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে সফলভাবে প্রবেশ করতে পারে।
বিশ্বসম্পর্কে বিনিয়োগ: জার্মানির কৌশলগত লাভ
এই গবেষণা আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছে—বিশ্বের প্রতিভাবান তরুণদের জার্মানিতে শিক্ষা দেওয়া শুধু স্বল্পমেয়াদি লাভ নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত বিনিয়োগ। এমনকি কেউ যদি ডিগ্রি শেষ করে অন্য দেশে ফিরে যান, তবুও জার্মানি একটি আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, যা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক সহযোগিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
অর্থনীতি, শিক্ষা ও অভিবাসন—এই তিন ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আজ জার্মানির জন্য এক শক্তিশালী সম্পদে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এখন প্রয়োজন ভবিষ্যতবান্ধব নীতি, যা এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের পরে দেশটির উন্নয়নযাত্রায় সক্রিয় সঙ্গী করে তুলবে।